বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চুল কাটা মিলি এখন ফুটবলার
অভিজিৎ ঘোষ, টাঙ্গাইল
প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পায় মিলি (১৩)। সেই খেলায় ভালো করে সে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় মিলিকে বিয়ে দিতে চায় তার পরিবার। বিয়ে এড়াতে কৌশলে মাথার চুল কেটে ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করে। পরবর্তীতে টাঙ্গাইল মোনালিসা ইউমেন্স স্পোর্টস একাডেমিতে ভর্তি হয়। এরপর থেকেই মিলির পরিবার তাকে সহযোগিতা করছে।
মিলির মতো আরও এক নারী ফুটবলার ঋতু (১৬)। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে ফুটবলের প্রতি তার নেশা। ঋতুর মা মারা যাওয়ার পর নানির কাছে মানুষ হয় সে। নানি অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি ঋতুর পড়াশুনার খরচ জোগাচ্ছে। এসএসসিতে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছে ঋতু। বর্তমানে সে বিকেএসপি ক্যাডেটে ভর্তি হয়েছে।
শুধু মিলি বা ঋতুই নয়, টাঙ্গাইলে হাজারো জয়িতা বৈরিতা ও সামাজিক কুসংস্কার এবং প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের চলার পথ এখনো সহজ নয়। বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বাধা সমাজ ও পরিবার দুই দিক থেকেই রয়েছে।
জেলার নারী সংগঠকরা জানিয়েছেন, যে রাধে সে চুলও বাঁধে। আবার সে গানও গায়। নারী-পুরুষের বৈষম্যগত মানসিকতা দূর না হলে নারী দিবসের সফলতা পাওয়া যাবে না।
অভিভাবকরা বলেন, মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেওয়ায় সামাজিকভাবে অনেক কটু কথা শুনতে হয়। মেয়েদের কেন খেলাধুলা করতে হবে? এতে পরবর্তীতে সমস্যায় পড়তে হবে। তারপরও পরিবার থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছি।
ফুটবলার সেলিনা বলেন, খেলাধুলা করায় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমার বাবা-মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এক পর্যায়ে পরিবার থেকেও খেলাধুলা করতে নিষেধ করা হয়। এরপর অনেক কষ্টে খেলাধুলা ধরে রেখেছি। একটু বড় হওয়ার পর তারা ভিন্নভাবে কথা শোনাতে শুরু করে।
আম্বিয়া বলেন, বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। পরবর্তীতে কাকার কাছে মানুষ হয়েছি। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছে অনেক। পরে কৌশলে বাড়ি থেকে চলে আসি। ফুটবল ক্লাবের ম্যামের সহায়তায় খেলাধুলা করছি।
বাড়িতে সম্প্রতি ফোন করে খরচ চেয়েছিলাম। দেয়নি। তারা বলেছে, আমার জন্য খরচ চালানো নাকি হারাম। সবার অমতে খেলাধুলা করায় পরিবার থেকে কোনো সহায়তা পাই না। বাড়িতে গেলেই তারা আমাকে জোর করে বিয়ে দিবে। আমি খেলাধুলা করতে চাই।
মিলি বলেন, স্বপ্ন এক সময় জাতীয় দলে ফুটবল খেলব। সেই স্বপ্ন থেকে খেলায় মনোনিবেশ করেছি। পরিবার থেকে বাল্যবিয়ে দিতে চাওয়ায় মাথার চুল কাটতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি এখন বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছি। পরিবারও এখন আমাকে সহায়তা করছে এবং বিয়ের জন্য আর চাপ দিচ্ছে না।
ঋতু বলেন, ছোটকালে মাকে হারিয়েছি। বাবাও অন্যত্র বিয়ে করেছে। তিনিও অসুস্থ। পরে নানির কাছে থেকে মানুষ হয়েছি। নানি অন্যের বাসায় কাজ করে আমাকে মানুষ করেছে। আমি এখন বিকেএসপিতে পড়াশুনা করছি। খেলাধুলায় ভাল করে দেশের জন্য কিছু করতে চাই।
টাঙ্গাইলের মোনালিসা ইউমেন্স স্পোর্টস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কামরুন্নাহার খান মুন্নি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দূর না হলে নারীর চলার পথ সহজ হবে না। সামাজিকভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। অর্থবিত্ত বা স্ট্যাটাস না দেখে অসহায় ও দরিদ্র এসব কিশোরীদের সহায়তায় সকলের এগিয়ে আসা উচিত।