
শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » অপরাধ ও দুর্নীতি » রামগতি-কমলনগরে বছরে ৬৫০০হেক্টর টপ সয়েল পুড়ছে ইটের ভাটায়
রামগতি-কমলনগরে বছরে ৬৫০০হেক্টর টপ সয়েল পুড়ছে ইটের ভাটায়
আমজাদ হোসেন আমু,লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি;
লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর উপজেলায় নির্মানককৃত ৬৭টা ইটের ভাটায় এক বছরে প্রায় ৬৫০০হেক্টর কৃষি জমির উর্বর মাটির ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব উর্বর(টপ সয়েল) দিয়ে ইট তৈরি করা হয়। কৃষি জমির উর্বর মাটি কৃষক নিজেই ইট ভাটায় বিক্রি করে ফসল উৎপাদনে ক্ষতি করছে। একশ্রেণি দালাল চক্রের মাধ্যমে মাটিগুলো বিভিন্ন ইটের ভাটায় যাচ্ছে। কৃষি জমির মাটি ছাড়া ইট তৈরি কোনমতে সম্ভব হচ্ছে না। টপ সয়েল কৃষি জমি থেকে হারিয়ে যাওয়ায় ফসলি জমির উর্বরতা ও উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চর কাদিরায় আল্লাহরদান ব্রিকস, এসবিএম, মা ফাতেমা, এমআরবি, জেইপি, এলএমজি ইটের ভাটায় গিয়ে দেখা যায় কৃৃষি জমির মাটি ট্রাক্টর দিয়ে টানা হচ্ছে। এবং প্রতিটি ইটের ভাটায় মাটির দু’তিনটা করে টিলা রয়েছে।
তথ্যমতে, টপ সয়েল হচ্ছে জমির মুল জৈবশক্তি। জমির উর্বরতার ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত মাটির উর্বর অংশ বা টপ সয়েল। ইট তৈরিতে কাচাঁমাল হিসেবে ইটের ভাটাগুলোতে টপ সয়েল ব্যবহার করছে মালিকরা। ইট তৈরিতে ফসলি কৃষি জমির উর্বর মাটি খুবই সুবিধাজনক ও লাভজনক উপাদান। এছাড়াও আইনমতে, কৃষি জমি, পাহাড়, টিলার মাটি কাটা নিষিদ্ধ রয়েছে। মাটি বা বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, কৃৃষি জমির মালিকদের ভুল বুঝিয়ে লোভ দেখিয়ে মাটি কিনছে এক শ্রেণির অসাধু মাটিখেকো চক্র। তারা নগদ টাকায় কৃষকদের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এক বছর ১৬০শতক কৃষি জমির ৮থেকে ১০ ইঞ্চি মাটি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২-৩লাখ টাকা। ফসল উৎপাদনের হার হিসেবে মাটির দাম বেশি থাকায় কৃষক লোভে পড়ে যায়।
স্থানীয় আরও জানান, রামগতি-কমলনগরে প্রায় ৮’শত দানব মাটি টানা ট্রাক্টর রয়েছে। এসব দিয়ে প্রতি বছর বিভিন্ন কৃষি জমির মাটি ইটের ভাটায় টানা হচ্ছে। একটি ইটের ভাটায় প্রায় ১৫টা করে দানব ট্রাক্টর প্রতিদিন মাটি টানছে। দানব ট্রাক্টরের অত্যাচারে কাঁচা-পাকা সড়কের বেহাল দশা তৈরি হচ্ছে। ভাঙ্গা চুরা সড়কে প্রতিনিয়ত যানবাহনে দূর্ঘটনা ঘটছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি জানান, কমলনগরে অসাধু মাটি কেনা-বেচা চক্রের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২০০জন। তারা সিজন ও আনসিজনে কৃষি জমির মাটি কিনে রাখে। মাটিগুলো কিনতে জমির মালিকের সাথে বিভিন্ন রকমে তালবাহনা করে। মাঝেমধ্যে চরের জমির মাটি জোরপূর্বক কেটে ইটের ভাটায় বিক্রি করে দেয়। মাটি কেনা-বেচা চক্রের গ্রুপ রয়েছে। এরা চক্রকারে প্রতি বছর কৃষি জমির মাটি সিন্ডকেট করে চওড়া দরে ভাটার মালিকদের নিকট বিক্রি করেন। এদের কথা আর কাজে ব্যাপক ফারাক থাকে। জমির মালিকদের সাথে কথা কাজে দুরুত্ব তৈরিতে মাটি চুরি করে।
হাজির হাট ইউনিয়নের কৃষি জমির মালিক পন্ডিত মিয়া জানান, তার এক একর জমির মাটি(এককোপ) এক ফুট বিক্রি করেন ১লাখ ১০হাজার টাকা। কোন টাকা না দিয়ে হঠাৎ জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে মাটি কাটা শুরু করে দালাল। জমি চর কাদিরার চর বসু এলাকায় অবস্থিত। হঠাৎ শুনতে পায় কে বা কাহারা জমির মাটি কাটছে। তড়িৎ গতিতে ট্রাক্টর আটকিয়ে মাটি রক্ষা করি। দালালের সাথে যোগাযোগ করি। সে টাকা না দিয়ে কেন মাটি নিচ্ছে জানতে চাই। পরে সন্ধ্যায় টাকা দিবে জানান। এভাবে মাটির দালাল চক্র কৃষকের জমির মাটি কিনে ধোকা দেয়। এদের ধরা খুবই মুশকিল।
মাটি ক্রেতা মো.আরিফ জানান, তিনি দীর্ঘদিন কৃষি জমির মাটি কিনে ইটের ভাটায় বিক্রি করেন। পন্ডিত মিয়ার জমির মাটি কিনেন। ইটের ভাটায় মাটি বিক্রি করেছেন। মাটি দিলে ভাটার মালিক টাকা দিবে, তখন জমির মালিককে মাটির টাকা বুঝিয়ে দিবে। কৃষি জমির মাটি কেনা-বেচা আইনগত অপরাধ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
চর কাদিরা ইউনিয়ন বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ইটের ভাটার ট্রাক্টরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ্য চর কাদিরা বাসি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা, মাঝে-মধ্যে গভীর রাতেও দানব ট্রাক্টর মাটি টানছে। সড়কে ধুলা-বালিতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। চর কাদিরা ইউনিয়নে ইটেে ভাটা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় কোন ভালো সড়ক নেই। সবগুলো সড়ক দানব ট্রাক্টর নষ্ট করে দিচ্ছে। মাটি টানা ট্রাক্টের স্কুলের বাচ্চারা দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
রামগতির চর আফজল এলাকার বাসিন্দা আলী মিয়া বলেন, চর আফজল মৌজায় প্রায় ২৫টা ইটের ভাটা রয়েছে। একটি গ্রামে এতগুলো ইটের ভাটা থাকলে গ্রাম এবং সড়কের কি অবস্থা হতে পারে..? কোন কৃষি জমি খালি নেই। ইটের ভাটায় প্রতিদিন মাটি যাচ্ছে। কৃষক নগদের আশায় কৃষি জমির উৎপাদন ধ্বংস করছে। এদের বুঝালেও বুঝছে চাচ্ছে না। যতদিন ইটের ভাটা থাকবে ততদিন মাটি কাটা, কৃষি জমির উর্বরতা হারাতে হবে।
ইটের ভাটার মালিকরা বলেন, প্রতি বছর একটি ইটের ভাটায় প্রায় ১০০হেক্টর কৃষি জমির মাটি লাগছে। কম-বেশি হতে পারে। তবে ইট তৈরিতে কৃষি জমির মাটি প্রধান কাঁচামাল। কৃষি জমির মাটি ছাড়া ইট তৈরি করতে অন্য মাটির ব্যবহারে অসুবিধা।
কমলনগর কৃষি কর্মকর্তা মো.শাহিন রানা বলেন, কৃষক কোনমতে পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়াতে চায় না। তারমধ্যে কৃষি জমির মাটি চওড়া দামে বিক্রি করে নগদ টাকা পাচ্ছে। তারা নগদে বিশ্বাসী। যে হারে কৃষি জমির মাটি ইটের ভাটায় কাটছে। ফসল উৎপাদনে খুব সংকট দেখা দিবে। কমলনগরে প্রায় ১৮টা ইটের ভাটা রয়েছে। প্রায় ২হাজার হেক্টর কৃষি জমির মাটি কাটা হচ্ছে প্রতিবছর। এসব মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহ্নত হচ্ছে। কৃষি জমির মাটি কাটা খুব দ্রুত বন্ধ করতে হবে। কৃষি জমির মাটি কাটা সম্পূর্ণ অবৈধ- বেআইনি। রামগতিতে ৪৯টা ইটের ভাটায় প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর কৃষি জমির মাটি ইটের ভাটায় যাচ্ছে। কৃষি জমির মাটি কাটা বন্ধ করতে হবে। দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কৃষি জমির উর্বর মাটি রক্ষা করতে হবে। কৃষকদের মাটি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে। মাটি কাটি বন্ধে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কমলনগর উপজেলা সহকারি কমিশনার(ভূমি) ঝন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, কৃষি জমি বা বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বেআইনি। কিছুদিন পূর্বে বালু উত্তোলনের দায়ে যুবকের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। যারা কৃষি জমির মাটু কাটছে, ইটের ভাটায় বিক্রি করছে তাদের ব্যাপারে অভিযান চলছে। রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছৈয়দ আমজাদ হোসাইন বলেন, ইটের ভাটায় বৈধতা কাগজপত্র যাচাই-বাচাই, কাঠ পোড়ানো, কৃষি জমির মাটি কাটা, দানব ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।